দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য বর্তমান সরকার শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে। উপবৃত্তি এবং অন্যান্য উদ্ভাবনীমূলক কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রকৃত চাহিদা মিটিয়ে তাদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং মাধ্যমিক শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দেশের ১২৫টি উপজেলায় 'সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট' (সেকায়েপ) বাস্তবায়ন করে। প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের অভূতপূর্ব সাফল্যের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকা আরও ৯০টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৩৫ উপজেলায় সম্প্রসারণ করে মোট ২৫০টি উপজেলায় উন্নীত করা হয়েছে এবং প্রকল্পের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে--মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, মাধ্যমিক শিক্ষায় সকল শিক্ষার্থীর সমঅংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং নিয়মিত পরিবীক্ষণের মাধ্যমে প্রকল্পাধীন উপজেলাসমূহের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষণ-শিখন ফলাফল মূল্যায়ন।
সেকায়েপ প্রকল্পের ৪টি কম্পোনেন্ট এবং ১৩টি সাব-কম্পোনেন্ট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে:
১. শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিক্ষণ-শিখন মান পরিবীক্ষণ সামর্থ্যরে উন্নয়ন:
এই কম্পোনেন্টের আওতায় রয়েছে উদ্দীপনা পুরস্কারের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন এবং বিধিবদ্ধভাবে শিক্ষণ-শিখন স্তরের পর্যালোচনা।
ইংরেজি গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষণ-শিখন সহায়তা: এই সাব-কম্পোনেন্ট-এর মাধ্যমে 'সেকায়েপ' মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে দূর্বল প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক নিয়োগ করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়তা করছে।
শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য উদ্দীপনা পুরস্কার কার্যক্রম: এই কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্জনসমূহকে আর্থিক পুরস্কারের মাধ্যমে আরো ভালো ফলাফল করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। উদ্দীপনা পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে ক) বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা ছাত্র-ছাত্রী কৃতিত্ব পুরস্কার; খ) পিএমটি ভিত্তিক উপবৃত্তিধারী এসএসসি/দাখিল পাশ করা ছাত্র-ছাত্রী উদ্দীপনা পুরস্কার; গ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কৃতিত্ব পুরস্কার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কৃতিত্ব পুরস্কার সেকায়েপভুক্ত উপজেলা ছাড়াও দেশের সব উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি: প্রকল্পভুক্ত ২৫০টি উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে 'পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি' বাস্তবায়নের জন্য সেকায়েপ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে নির্বাচন করেছে। মে ২০১০-এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে এবং সংশোধিত প্রকল্প দলিল অনুযায়ী ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। এই কর্মসূচির আওতায় (ক) প্রকল্পভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বইপড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি; (খ) বয়স ও মনোপযোগী সুন্দর সুখপাঠ্য এবং উন্নত মান সম্পন্ন বাংলা ও ইংরেজি বই পড়ার ব্যবস্থা করা; (গ) পঠিত বই-এর মূল্যায়ন; (ঘ) পাঠ মূল্যায়ন শেষে মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদান করা। সংশোধিত প্রকল্পে প্রতিষ্ঠান বই পড়ার পাশাপাশি অনলাইনে বই পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
শিক্ষার গুণগতমান মূল্যায়ন: এই সাব-কম্পোনেন্টের লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে জাতীয় পাঠ্যক্রমের আলোকে নমুনাভিত্তিক শিক্ষার মান যাচাই করা। জুলাই ২০১১ মাসে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের মধ্য-মেয়াদী মূল্যায়ন (MTR)-এর সুপারিশের আলোকে সেকায়েপ প্রকল্প মেয়াদে দুইবার শিখন ফলাফল মূল্যায়ন করবে। ইতোমধ্যে ২০১২ সালে ৮ম শ্রেণি ও ২০১৩ সালে ৬ষ্ঠ এবং ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত বিষয়ে শিখন ফলাফল মূল্যায়ন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে এই মূল্যায়ন করা হবে।
২. সমতাভিত্তিক প্রবেশাধিকার উন্নয়ন:
এই কম্পোনেন্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে দরিদ্র ছাত্র ও ছাত্রীদের অধিকহারে অংশগ্রহণ ও এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তাদেরকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখার লক্ষ্যে একটি দরিদ্রমুখী উপবৃত্তি ও টিউশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা এবং প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ উন্নত করা।
প্রক্সি মিন্স টেস্টিং (পিএমটি)-এর মাধ্যমে অতি দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি ও টিউশন ফি কার্যক্রম: এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে পিএমটি ভিত্তিক উপবৃত্তি ও টিউশন ফি প্রদানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও ঝরে পড়ার হার হ্রাস করা। প্রক্সি মিন্স টেস্টিং (পিএমটি) একটি পরিবারভিত্তিক প্রো-পুওর টার্গেটিং পদ্ধতি যা আবেদনকারীগণকে কিছু নির্ধারিত চলকের (Variable) ভিত্তিতে বাছাই করে সুবিধাভোগীগণকে চিহ্নিত করে।
স্কুল সুবিধা উন্নয়ন কার্যক্রম: ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও অবস্থান নিশ্চিত করতে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবছর এই কর্মসূচির আওতায় নলকূপগুলোতে আর্সেনিকের মাত্রা ও বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সংস্কার ও আসবাবপত্র সংগ্রহের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানে ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ:
এ কম্পোনেন্টের উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে (ক) প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার বিদ্যমান কাঠামো শক্তিশালীকরণ, (খ) শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং অভীষ্ট সুবিধাভোগীগণকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং (গ) প্রতিষ্ঠান ও উপজেলা পর্যায়ে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি: এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো কেন্দ্রীয়, উপজেলা এবং কম্যুনিটি পর্যায়ে উন্নত সেবা প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, সেকায়েপ এবং মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ অনুুবিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা: এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিক্ষক-অভিভাবক সমিতি এবং সকল স্টেকহোল্ডার-কে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা।
আইসিটি সাপোর্ট: প্রকল্পভুক্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথ্য প্রযুক্তি সেবা সুলভ করার লক্ষ্যে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যয় বাবদ প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারে আইসিটি গ্রান্ট প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা সচেতনতা এবং সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম: সকল পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারগণের শিক্ষার প্রতি অধিকতর সচেতনতা ও আগ্রহ বৃদ্ধি করা এই কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য।
৪. পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন:
বাস্তবায়নাধীন সকল প্রকল্প পরিবীক্ষণের জন্য সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় ২০০৮ থেকে মাউশি অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অণুবিভাগ স্থাপন করা হয়েছে। পরিবীক্ষণ (Monitoring): এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন তথ্যপ্রবাহ সমন্বয়, তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদকরণ ও প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং বিশেষায়িত কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি।
মূল্যায়ন: এই সাব-কম্পোনেন্টের আওতায় প্রকল্পের সম-অংশগ্রহণ ও মান উন্নয়ন সংক্রান্ত উদ্যোগসমূহের কার্যকারিতা ও প্রভাব যাচাইয়ের জন্য বেইজলাইন জরিপ (পরিবার ও স্কুল ভিত্তিক) ও ফলোআপ জরিপের মাধ্যমে একটি ব্যাপকভিত্তিক ফলাফল মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
প্রকল্পের বর্ণিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প পরিচালকের নেতৃত্বে উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, শিক্ষা কর্মকর্তা, কনসালটেন্টবৃন্দ ও সহায়ক জনবল প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। উপজেলা শিক্ষা অফিস, প্রতিষ্ঠান প্রধান, এসএমসি, পিটিএ-সহ সকলের যৌথ প্রয়াসে সফলতার সাথে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।